১৯৪৭-১৯৫৮: গণতন্ত্র বিকাশের সম্ভাব্য সময়কাল - ওমর খালেদ রুমি

“Sovereignity over the entire universe belongs to God Almighty alone and the authority which he has delegated to the state of Pakistan through its people for being exercised within the limits prescribed by Him is a sacred trust.”

পাকিস্তানের ১৯৫৬, ১৯৬২ এবং ১৯৭৩ সালের সংবিধানে গৃহীত সাবজেক্ট ক্লজ

পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ মারা গিয়েছিলেন ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে আর এর মাত্র তিন দিন পর ১৪ই সেপ্টেম্বর খাজা নাজিমুদ্দীন গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব নেন। এই খাজা নাজিমুদ্দীন সম্পর্কে একটু আলোচনা করা দরকার। তিনি জন্মেছিলেন ১৯শে জুলাই ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। মারা গিয়েছিলেন ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২২শে অক্টোবর। রাজনীতিতে তার প্রথম বড় সাফল্য ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে এপ্রিল বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ। এই পদে তিনি বহাল ছিলেন ১৯৪৫ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত। দেশভাগ পরবর্তীকালে তিনি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। এই পদে তিনি জিন্নাহ্র মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিলেন। ১১ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জিন্নাহ্র মৃত্যু হলে ১৪ই সেপ্টেম্বর তিনি পূর্ব বাংলার মুখ্য মন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব নেন। এই পদে তিনি বহাল ছিলেন ১৭ই অক্টোবর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মালিক গুলাম মোহাম্মদ-এর দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত। ১৭ই অক্টোবর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে গভর্ণর জেনারেলের দায়িত্ব ত্যাগ করার পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কারণ ১৬ই অক্টোবর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। উক্ত পদে তিনি ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। এই সময়কালে তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

এতো গেলো তার রাজনৈতিক জীবনের কথা। ব্যক্তিগত জীবনে তার জন্ম হয়েছিলো বাংলার সম্ভ্রান্ত নবাব পরিবারে। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ¯œাতক ডিগ্রী অর্জনের পর মাস্টার্স করেছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কিংবা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যে পদেই থাকুন না কেন বাঙালি এই রাজনীতিবিদ বাংলা ভাষার প্রতি ছিলেন ঘোর বিরোধী।

১৯৫৩ সালে তাকে তার নির্বাচিত গভর্নর জেনারেল মালিক গুলাম মোহাম্মদের ষড়যন্ত্রেই ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হন মোহাম্মদ আলী বগুড়া যিনি ব্যক্তিগত জীবনে একজন কূটনীতিক ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তার দল মুসলিম লীগ প্রতিদ্ব›িদ্বতা করে এবং ব্যাপক ভরাডুবির সম্মুখীন হয়। এর কিছুদিন পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতে অনিশ্চিত হয়ে যায়। আর এভাবে অসুস্থতার মধ্য দিয়ে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোক গমন করেন।

উপরের আলোচনাটুকুর মধ্যে বেশ কয়েকজন আলোচিত ব্যক্তিত্বের কথা চলে এসেছে। এদের মধ্যে জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, মালিক গুলাম মোহাম্মদ এবং মোহাম্মদ আলী বগুড়ার নাম উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে অনেকেই পাঠকদের কাছে সুপরিচিত। তবু নবীন পাঠকদের সুবিধার্থে কারো কারো সম্পর্ক উপর্যুক্ত টীকা যুক্ত করা হবে। আর এই আলোচনার স্বার্থে যাদের প্রাসঙ্গিকতা বেশী তাদের সম্পর্কে সরাসরি এই অধ্যায়ের ভেতরেই আলোচনা করা হবে। এরকম একজনই ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। তাই আমরা তার সম্পর্কে কিছুটা হলেও আলোকপাত করেছি। এবার আমাদের আলোচনার স্বার্থে যার সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়োজন মনে করছি তিনি মালিক গুলাম মোহাম্মদ। বিতর্কিত এই চরিত্রটির কার্যকলাপগুলো পাঠকদের সামনে তুলে না ধরলে তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক অবস্থার ধরণ-ধারণ একটুও স্পষ্ট হবে না। তাছাড়া কেন্দ্রীয় এসব রাজনীতিবিদদের আচরণ তথা কার্যকলাপ পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির গতিপথ তথা রাজনৈতিক কর্মকান্ড, গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলো।

প্রসঙ্গক্রমে ধীরে ধীরে আমরা মূলত সেই আলোচনায়ই যাবো। তবে তার আগে যদি আমরা তৎকালীন রাজনীতির গতিপথ, ক্ষমতার পট পরিবর্তন এবং কুশীলবদের পরিচয় না করিয়ে দেই পাঠকদের কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আমরা পাঠকদের আবারও মনে করিয়ে দিতে চাই এই বইয়ে আমাদের উদ্দেশ্য ৬ দফার আগে ও পরে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গতিপথ, তার প্রকৃতি, গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহ, পরিচালিত আন্দোলনসমূহ ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ে আলোকপাত করা। আর এই বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করার জন্যে আমাদের উক্ত সময়কালীন রাজনীতির একটা পরিষ্কার চিত্রতো দরকারই পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যাপারগুলোরও পরিষ্কার ধারণা দরকার। কারণ এসব বিষয়গুলোই পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য গড়ে দিয়েছিলো যার সমাধানকল্পে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে তখনকার রাজনীতিবিদরা ভুল বুঝলেও কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে বোঝার চেষ্টা না করা এই ঐতিহাসিক ৬ দফাই ছিলো পাকিস্তানে গণতন্ত্রের রাজনীতির রক্ষাকবচ এবং পাকিস্তানের টিকে থাকারও মূলমন্ত্র। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা ছয় দফার মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হলো তখন পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরা কিন্তু সৃষ্ট সুযোগ নিতে ভুল করলেন না। শেখ মুজিব কখনও তার নিজের কথা ভাবেননি। তিনি পাকিস্তানের উভয় প্রান্তের একটা বিরাট জনগোষ্ঠীর জন্যে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্যে দারুণ সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু সবাই যখন এটা বুঝতে ব্যর্থ হলো তখন সামরিক শাসন তাদের উপর চেপে বসলো।

১৯৫৮ সালে শুরু হওয়া এই স্টিম রোলার ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময় পাকিস্তানের উভয় প্রান্তের মানুষেরই জীবনযাত্রাকে কম-বেশী পিষ্ঠ করেছিলো। যদি তা না হতো ৬ দফার দাবীতে বাঙালি যখন মাঠে নামলো তখন প্রথম দিকে সাড়া না মিললেও ১৯৬৮ সালে এসে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও উপলব্ধি করলো রাজপথে নামার প্রয়োজনীয়তা। তাসখন্ড চুক্তির আগ পর্যন্ত তাদের কাছে কোন কিছুই তেমন একটা অবমাননাকর মনে হয়নি। কিন্তু এর পরই তাদের অবস্থান আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানের ৬ দফার আন্দোলনের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ইস্যুগুলোর পক্ষে রাজপথে নেমে আসে। উভয় প্রান্তের আন্দোলন সামাল দেওয়া আইয়ুব খানের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আর এরকম একটা পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত তাকে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ আরেক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সরে যেতে হয়েছিলো।

আমরা মালিক গুলাম মোহাম্মদ সম্পর্কে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। মাঝখানে কিছু অনিবার্য কথাবার্তা এসে পড়লো। এই বইয়ে প্রসঙ্গক্রমে এ রকম আলোচনা চলে আসবে। কিন্তু যথাসময়ে আমরা আবারও আমাদের মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাবো।

রাজনীতিতে মালিক গুলাম মোহাম্মদের উত্থান ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ই আগষ্ট অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের মধ্যে দিয়ে। তিনি ১৯৫১ সালের ১৯শে অক্টোবর পর্যন্ত এই পদে দায়িত্বরত ছিলেন। ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন এবং মালিক গুলাম মোহাম্মদ গভর্ণর জেনারেলের দায়িত্ব নেন।

“Nationalwide violence as the aftermath of the language Movement in Dacca and religious riots in Lahore made him dismiss Nazimuddin administration using the reserve powers to restore control of the law and order in Pakistan”

মালিক গুলাম মোহাম্মদ ১৯৫৫ সালের ৭ই আগষ্ট পর্যন্ত গভর্ণর জেনারেলের পদে বহাল ছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইস্কান্দার মির্জা তাকে তার স্বাস্থ্যগত অজুহাত দেখিয়ে অবসরে যেতে বাধ্য করেন এবং নিজে গভর্নর জেনারেলের পদে বহাল হন।

“In 1955, he was forced to resign from the post of Governor General due to worsening of his health conditions by then-interior Minister Iskander Ali Mirza, who himself took control of the office. After resignation, he fought a brief but unsuccessful battle with his illness that ultimately resulted in his death in 1956.”

পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনীতির এক বিচিত্র চরিত্র এই ইস্কান্দার মির্জা যার সময়ে চার চার জন প্রধানমন্ত্রী নানা অজুহাতে তাদের দায়িত্ব হারান। এইসব অসহায় এবং হতভাগা প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আমাদের গণতন্ত্রের মানসপুত্র জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামও আছে। বাকি তিন দুভার্গার নাম হলো মোহাম্মদ আলী (১৯৫৬), আই, আই, চুন্দ্রীগড় (১৯৫৭) এবং ফিরোজ খান নুন (১৯৫৭)। সামান্য সব অজুহাতে রাজনীতির কূটচালের প্রয়োগে এদের সবাইকে একের পর এক সরিয়ে দেওয়া হয়।

ইস্কান্দার মির্জার জন্ম ১৩৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর। ১৯৬৯ সালের ঐ একই দিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রাজনীতিতে তার উত্থান হয়েছিলো ২৩শে অক্টোবর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বগ্রগণের মাধ্যমে। এরপর তিনি তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে পূর্ব বাংলার গভর্ণর, পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেলের দায়িত্ব সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ ও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর আইয়ুব খান কর্তৃক অপসারিত হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করছিলেন যে পদে তিনি আসীন হয়েছিলেন ২৩শে মার্চ ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে। তার পদচ্যুতির মাধ্যমে সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের লৌহযুগ চালু হয় যা উভয় পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি রাজনীতিরও সর্বনাশ ডেকে এনেছিলো। এই সময়কাল সম্পর্কে বলা হয়েছে,

“Democracy was stalled by the martial law that had been enforced by President Iskandar Mirza, who was replaced by the army chief, General Ayub Khan. After adopting a presidential system in 1962, the country experienced exceptional growth until a second war with India in 1965 that led to an economic downturn and wide-scale public desapproval in 1967. Consolidating control from Ayub khan in 1969, president Yahya Khan had to deal with a devastatiag cyclone that caused 500000 deaths in East Pakistan.”

সামরিক শাসনের ফাঁদে সেই যে পাকিস্তান পা রেখেছিলো ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের পতন হলেও সে অবস্থা থেকে পাকিস্তানীদের আর মুক্তি মেলেনি। সেই পথ ধরে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইয়াহিয়া খান। অবশেষে ১৯৭০ এর নির্বাচন পাকিস্তানের দুই অংশের জন্যে পৃথক পথ দেখিয়ে দিলো। একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলো পুরোটা ১৯৭১ সাল জুড়ে ইচ্ছে করলেই যা এড়িয়ে গিয়ে পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা যেতো। শেখ মুজিবের মতো একজন বিগদ্ধ, ন্যায় পরায়ন, গণতন্ত্রমনা, সৎ ও উদার রাজনীতিবিদ যিনি অন্যের প্রতি আগাগোড়াই আগাগোড়াই শ্রদ্ধাশীল তাকে কেন যে পশ্চিম পাকিস্তানীরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারলো না এর জবাব আজও আমার কাছে সন্তোষজনক নয়। আসলে পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাদের মিথ্যে অহমিকা বোধ যার মূলে ছিলো মূলত পাঞ্জাবী সামরিক সখ্যাগরিষ্ঠতার ঐতিহ্যগত অহংকার তার থেকে শেষ পর্যন্তও বেরিয়ে আসতে পারেনি। পাশাপাশি ভুট্টোর ক্ষমতার লোভ এবং একগুঁয়েমিও কম দায়ী নয়। তারা কি একবারের জন্যেও ভাবেনি মুজিব কোন দুর্বল প্রতিপক্ষ নয়। ১৭০ আসনের মধ্যে যে মানুষটি ১৬৮টি আসন বিজয়ী হবে তার নিরংকুশ শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে বাঙালি যে তার কথায় যখন তখন হাঁটুজলেও নেমে পড়বে তা তো না বোঝার কথা নয়। আসলে ধ্বংসের আগে সকল জাতিরই এরকম একটা ইগো চেপে বসে যা থেকে সে আর বেরিয়ে আসতে পারে না। অবাক হওয়ার কিছু নেই পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। আর বাংলাদেশের জন্ম নেওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছিলো এই একগুঁয়েমির অনিবার্য পরিণতি।

যে প্রসঙ্গে ছিলাম। ইস্কান্দার মির্জা তখন গভর্নর জেনারেল। এর মধ্যে ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণয়ন করা হলো। নতুন সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন। গভর্নর জেনারেলের পদটি চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেলো। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মুহাম্মদ আলী বগুড়া। ইস্কান্দার মির্জা তাকে সরিয়ে দিলেন। প্রধানমন্ত্রী বানালেন মোহাম্মদ আলীকে। বছর না ঘুরতেই তাকেও সরিয়ে দিলেন। প্রধানন্ত্রীর দায়িত্ব নিলেন হোসেন শহীদ সোররাওয়ার্দী। ওদিকে ২৩শে মার্চ ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ১৯৫৭ সালে সোহরাওয়ার্দীকেও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে বিদায় নিতে হলো। ক্ষমতায় আনলেন ফিরোজ খান নুনকে। পরের বছর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের পরামর্শ অনুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘোষনা করলেন। ফিরোজ খান নুনের মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিলেন। সামরিক সদস্যদের প্রাধান্য দিয়ে গড়া নতুন মন্ত্রীসভায় আইয়ুব খানকে মন্ত্রীর পদ দিলেন। মাত্র কয়েকদিনের মাথায় সেই আইয়ুব খানই তাকে জীবনের হুমকি দিয়ে সকল ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নিয়ে চিরতরে দেশ ছাড়তে বাধ্য করলেন।

জীবনের বাকী দিনগুলো বিদেশের মাটিতে তার অত্যন্ত করুণ আর অবমাননাকর অবস্থার মধ্য দিয়ে কেটেছে। শোনা যায় পাকিস্তানের একসময়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি জীবনের শেষের দিকের বছরগুলোতে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে লন্ডনের মাটিতে ভারতীয়দের মালিকানাধীন হোটেলের ম্যানেজারের চাকুরী করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

ইস্কান্দার মির্জা আইয়ুব খানের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারেননি। গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ বন্ধ করে দিয়ে তিনি সামরিক প্রশাসকের জন্যে যে পথ তৈরী করেছিলেন তার প্রথম শিকারটা তাকেই হতে হয়েছিলো। সেই যে পাকিস্তানের সর্বনাশ হলো সেখান থেকে তারা আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। উল্টো ভাঙ্গনের সুর শোনা গেলো ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে জন্ম হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। হায়রে নিয়তি! কথায় বলে না, আমও গেলো, ছালাও গেলো। একটার পর একটা ভুলে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ভেঙ্গে দুটুকরো হলো। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাংলাদেশের জন্মদাতা, বাঙালির জাতির জনক। হাজারের বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তো আর তিনি শুধু শুধু নির্বাচিত হননি। ইতিহাসে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে কে কতোটা পাওয়ার যোগ্য। সময়ই বলে দিয়েছে একজন মুজিব এবং অন্যদের সাথে কতোটা তফাৎ।

এই সংক্ষিপ্ত লেখায় আমরা অবশ্য মুদ্রার এক পিঠের সামান্য আলোচনা করেছি। পূর্ব বাংলার তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির আলোচনা করার সুযোগ এই প্রবন্ধে নেই যার বেশীরভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে শেখ মুজিবের বর্ণাঢ্য জীবনের মহাকাব্যিক সব অধ্যায়গুলো। আসলে ইতিহাস যাকে অমরতœ দেয়, দেয় মাহাত্ম্য তাকে ¤øান করার সাধ্য কার। আর এই ইতিহাস লেখা হয়েছিলো মানবতার অক্ষরে যার অগ্রপথিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। মানুষের অকাতর ভালোবাসায় ধন্য মানুষটি ছিলেন এক কথায় বলতে গেলে গড গিফ্টেড। সৃষ্টিকর্তার রহমত ও বরকতে সমৃদ্ধ ছিলো এই মানুষটির জীবন। তিনি তাই প্রায়ই বলতেন “ও ধস ধ মড়ড়ফ গঁংষরস”। তার প্রতি আল্লাহ্র এই অসীম রহমতের কথা তিনি কখনও ভোলেননি।

To view or add a comment, sign in

Explore topics